ব্রিটিশ অভিবাসন কর্তৃপক্ষ ইউকেবিএ বিমান বন্দরে ভিসা পরিক্ষা করছে
ব্রিটিশ সরকার গত কয়েক মাসে ছাত্র ভিসার নিয়ম কানুন কঠোরতর করার ফলে হাজার হাজার বাংলাদেশী ছাত্রের ভিসা বাতিল হয়ে যেতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে৻বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত যেসব বেসরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে পড়তে আসেন, নিয়ম-কানুনের কড়াকড়ির ফলে সেগুলোর বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৻
ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন দফতর ইউনাইটেড কিংডম বর্ডার এজেন্সী বা ইউকেবিএ জানিয়েছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া কলেজগুলোর ছাত্র-ছাত্রীরা যদি দু‘মাসের মধ্যে নতুন কোন কলেজে ভর্তি হতে না পারে, তাদের যুক্তরাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে৻
লন্ডনে বাংলাদেশী মালিকানাধীন কয়েকটি কলেজের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, আগামী কয়েক মাসে অন্তত ২০ হতে ২৫ হাজার বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী তাদের ভিসা নবায়ন নিয়ে সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে৻
পূর্ব লন্ডনে এক ইমিগ্রেশন আইনজীবির অফিস৻
গত কয়েকদিন ধরে যারা এখানে নানা ধরণের পরামর্শের জন্য ভিড় করছেন, তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী৻
২০১০ সালে ব্রিটেনে উচ্চ শিক্ষার জন্য আসেন বাংলাদেশী ছাত্র মারুফ আহমেদ৻

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেরেসা মে সংসদে নতুন ভিসা নীতি ঘোষনা করছেন
ছাত্র ভিসার নিয়মকানুনে সরকার যে কড়াকড়ি করেছে, তার ফলে ভিসা নবায়ন করতে পারছেন না তিনি৻
"আমি মাত্র এক সপ্তাহ ক্লাশ করতে পারিনি, মানসিকভাবে একটু চাপের মধ্যে ছিলাম৻ নার্ভাস ছিলাম৻ কারণ আমি ভিসা নবায়নের জন্য আবেদন করতে যাচ্ছিলাম‘‘, মি অঅহমেদ বলেন৻
‘‘আমি কিন্তু আমার পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম৻ কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ একদিন আমাকে ডেকে বললো আমি আর ছাত্র নেই৻ আমাকে এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে৻"
মারুফ আহমেদ জানান, কলেজ কর্তৃপক্ষ তার পাঁচ হাজার পাউন্ড টিউশন ফি পর্যন্ত ফেরত দেয়নি৻ বরং তাকে উল্টো ভয় দেখিয়েছে যে পুলিশ ডেকে তাকে ধরিয়ে দেয়া হবে৻
ভিসা উত্তীর্ণ হওয়ায় মারুফ আহমেদ এখন ব্রিটেনে অবৈধ অভিবাসী৻ তাকে রীতিমত পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে৻
"আমি বুঝতে পারছি না এখন আমি কি করবো৻ আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে৻ তাদের কাছ থেকে এতগুলো টাকা নিয়ে এদেশে পড়তে এসেছি৻ তাদেরকে এখন কি বলবো? আমার পুরো ভবিষ্যত তো এখন অনিশ্চিত হয়ে গেল৻"
মারুফ আহমেদ যে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, সেটি একটি বেসরকারী কলেজ৻
বাংলাদেশ থেকে যারা ব্রিটেনে উচ্চ শিক্ষা নিতে আসেন, তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ, কোনও কোনও হিসেবে শতকরা আশিভাগ, পড়তে আসেন এ ধরণের কলেজেই৻

হিথ্রো বিমানবন্দরে বিদেশী ছাত্র-ছাত্রী
বাবা-মার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে এখানে পড়তে এসেছি৻ কিন্তু এখন আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে৻ তাদের এখন কি বলবো?
মারুফ আহমেদ, একটি বেসরকারি কলেজের ছাত্র
"বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিদিনই এধরণের সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসছে৻ অনেকের দেখা যাচ্ছে নতুন করে আবেদন করার মতো অর্থকড়ি নেই, প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র নেই৻ এর ফলে এসব ছাত্রের ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস অবৈধ হয়ে যাচ্ছে৻"
ব্রিটেনে বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনার পাশাপাশি খন্ডকালীন কাজের সুযোগ পেতেন৻
কিন্তু বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য সেই সুযোগ তুলে দেয়া হয়েছে৻
এর পাশাপাশি আর্থিক সচ্ছলতা প্রমাণের নিয়মও কঠোর করা হয়েছে৻
সেই সঙ্গে ইংরেজী ভাষার দ্ক্ষতা প্রমাণের জন্য নতুন করে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তাদের৻
এসব নিয়মকানুনের কারণে ২০ হতে ২৫ হাজার বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীর ভিসা বাতিল হয়ে যেতে পারে, বলছেন একটি বেসরকারি কলেজের একজন কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম৻
আমার ধারণা অন্তত ৬০ হতে ৭০ শতাংশ বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী তাদের ভিসা নবায়ন করতে পারবে না৻
অন্তত ২০ হতে ২৫ হাজার বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী এই বিপদে পড়তে যাচ্ছে৻ এদের ভবিষ্যত অন্ধকার", বলছিলেন রবিউল ইসলাম৻
উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ব্রিটেন ছিল বরাবরই এক আকর্ষণীয় গন্তব্য৻

অনেকের ভিসার আবেদন নাকচ হয়ে যাচ্ছে
অন্তত বিশ হতে পঁচিশ হাজার বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী বিপদে পড়তে যাচ্ছে
রবিউল ইসলাম, একটি বেসরকারি কলেজের কর্মকর্তা
আইনজীবি মনোয়ার হোসেন বলেন, ছাত্রমহলে ভিসা কলেজ নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানগুলোই একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকেই এই সংকট৻
"ছাত্ররা যখন এখানে পড়তে আসে, তারা কলেজ সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ খবর নেয় না৻ কলেজটার বয়সই হয়তো দুতিন বছর৻
সেটার কোন ক্লাসরুম নেই, লাইব্রেরী নেই, প্রয়োজনী শিক্ষক নেই৻ হয়তো বাংলাদেশী, ভারতীয় কিংবা চীনারা এসব কলেজ চালায়৻
সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এসব কলেজ চালানো হয়৻ এখানে শিক্ষার মান নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই৻"
ভিসা কলেজ
গত কয়েক মাসে কেবল মাত্র লন্ডনেই এধরণের অন্তত তিরিশটি কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে, যেগুলোতে বাংলাদেশী ছাত্ররাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ৻মনোয়ার হোসেন জানালেন, ছাত্র মহলে এসব কলেজ "ভিসা কলেজ" নামে পরিচিত৻
কারণ ইমিগ্রেশন আইনের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে যে কোন ভাবে ছাত্রদের ভিসা যোগাড় করে দেয়াই ছিল এদের মূল উদ্দেশ্য৻
কিন্তু সরকারের কড়াকড়ির পর এসব কলেজ এখন আর টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না৻
আগে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে ছাত্ররা নতুন কোন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভর্তি হতে পারতেন৻
কিন্তু এখন কলেজ পরিবর্তন করতে গেলেও ইমিগ্রেশন দফতরের অনুমতি প্রয়োজন হয়৻ মনোয়ার হোসেন বললেন, সে কারণেই ছাত্ররা এখন আরও বেশি সংকটে পড়েছে৻

বিদেশে ছাত্ররা ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষা চায়
বেশিরভাগ বাংলাদেশী ছাত্র এখানে কাজ করতে এসেছে, পড়াশুনা করতে নয়
আবু সাব্বির, অধ্যক্ষ, সেন্ট পিটার্স কলেজ
কিছুদিন এখানে খন্ডকালীন কাজ করেছেন ফাস্ট ফুডের দোকানে৻ এরপর চালু করেন এই কলেজ৻
আবু সাব্বির স্বীকার করলেন, বেসরকারি কলেজগুলোর ছাত্রদের কাজের অনুমতি বাতিল করে দেয়ায় তাদের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বড় ধরণের সংকটে আছে৻
"আমাদের কলেজে নতুন করে ভর্তির জন্য আবেদন প্রায় অর্ধেক কমে গেছে৻ অন্য অনেক কলেজের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে৻ কিছু কলেজ নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে৻ কিছু কলেজ ইউকেবিএ বন্ধ করে দিয়েছে৻"
তবে এসব কলেজের বিরুদ্ধে ছাত্ররা যেসব প্রতারণার অভিযোগ এনেছে, আবু সাব্বির তা অস্বীকার করলেন৻
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে যারা বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে ছাত্র ভিসা নিয়ে এসেছে, তাদের বেশিরভাগই এখানে কাজ করতে এসেছে, পড়াশুনার উদ্দেশ্যে নয়৻
তবে মারুফ আহমেদের মতো যারা ভিসা বাতিল হওয়ায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তারা মনে করেন, ছাত্রদের দুর্বলতা এবং অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এসব কলেজ ব্যবসা করেছে৻
তিনি বলেন, এসব কলেজকে পরিচালনার অনুমতি দেয়ায় এই প্রতারণার আংশিক দায় ইউকেবিএ কর্তৃপক্ষের ওপরও বর্তায়৻
"ইউকেবিএ তো এসব কলেজের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি৻ ছাত্রদের জীবন এভাবে ধ্বংস করে দেয়ার অধিকার এসব কলেজের নেই৻"
ছাত্রদের এসব অভিযোগের জবাবে ইউকেবিএ‘র একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, কলেজগুলো যেন আর ছাত্রদের সঙ্গে প্রতারণা করতে না পারে, সে লক্ষ্যেই তারা এখন ভিসা পদ্ধতিতে কড়াকড়ি করেছেন৻
‘‘কারণ পুরনো ভিসা পদ্ধতি নিম্নমানের কলেজগুলোর হাতে ছাত্রদের প্রতারণা বন্ধ করতে পারছিল না৻ যেসব পরিবর্তন এখন আনা হয়েছে, তার ফলে ভিসা পদ্ধতির অপব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হবে৻‘‘
কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যেসব ছাত্র ভিসা নিয়ে সংকটে পড়েছেন, তাদের অভিযোগের ব্যাপারে ইউকেবিএর মুখপাত্র এই বিবৃতিতে বলেন, যেসব ছাত্রের কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে, তারা ৬০ দিনের মধ্যে নতুন কোন বৈধ কলেজে ভর্তি হতে পারেন৻
‘‘কিন্তু যদি তারা ৬০ দিনের মধ্যে নতুন কোথাও ভর্তি হতে না পারেন, তাদের যুক্তরাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে৻‘‘
শত শত বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী তাদের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় ইতোমধ্যে এরকম ডিপোর্টেশন বা দেশ থেকে বহিস্কৃত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন৻
আগামী কয়েক মাসে এদের সংখ্যা আরও বহুগুণ বাড়বে বলে আশংকা করছেন এসব কলেজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ৻
No comments:
Post a Comment